📱 "মতিউরের মোবাইল বিপ্লব"
লেখক. প্রিন্স নাইম
সার্বিক সহযোগিতা. রাকিব হোসাইন. তামিম মোল্লা
সালটা ছিল ২০২৩।
মতিউর রহমান তখন মাত্র একটি সাধারণ বাটন ফোন ব্যবহার করত। ফেসবুক বা ইউটিউব দেখা তো দূরের কথা, ঠিকমতো একটা ছবি তোলাও তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু তার মনে ছিল একটা স্বপ্ন—সে চায় কিছু একটা আলাদা করতে, নতুন কিছু শিখতে, সবার থেকে একটু আলাদা কিছু বানাতে।
২০২৪ সালে সে এসএসসি পরীক্ষা দেয়। অনেক কষ্ট করে, রাত জেগে পড়াশোনা করে — শেষ পর্যন্ত ভালো রেজাল্ট করে। পরিবারে সবার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। খুশিতে তার বাবা তাকে উপহার দেন একটি নতুন স্মার্টফোন।
সে-ই ছিল মতিউরের জীবনের মোড় ঘোরানোর মুহূর্ত।
নতুন মোবাইলটা হাতে পাওয়ার পর মতিউরের মন ভরে যায়। সে ইউটিউব দেখে ভিডিও এডিটিং শেখে, ফেসবুকে রিল বানাতে শুরু করে। নিজের গ্রামের ছোট ছোট ঘটনা, তথ্যভিত্তিক কনটেন্ট, টিউটোরিয়াল—এসব নিয়েই ভিডিও বানানো শুরু করে।
📸 কিন্তু বাধা আসে এখানেই।
তার বন্ধুরা হাসাহাসি শুরু করে। কেউ বলে,
— "এইসব ভিডিও বানিয়ে লাভ কী হবে রে!"
আরেকজন বলে,
— "তুই কী influencer হইতে চাস নাকি?"
তাদের চোখে মতিউর একজন 'আলতু-ফালতু' টাইপ ছেলেতে পরিণত হয়।
তবু মতিউর থামে না। সে জানে, আজকে যারা হাসছে, একদিন তারাই অবাক হয়ে বলবে, “দোস্ত, তোর ভিডিওটা তো একদম ফাটাফাটি!”
২০২৫ সালে মতিউর ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার শেষ করে সেকেন্ড ইয়ার ভর্তি নিচ্ছে। আর ততদিনে তার ফেসবুক পেজে ৫০ হাজারের বেশি ফলোয়ার, ইউটিউব চ্যানেলে এসেছে মনিটাইজেশন। প্রতিমাসে সে মোবাইল দিয়ে ভিডিও বানিয়েই ইনকাম করছে যা দিয়ে নিজের খরচ চালাচ্ছে, এমনকি বাবা-মায়ের হাতেও টাকা দিতে পারছে।
এখন বন্ধুরা আর কিছু বলে না। বরং বলছে,
— “ভাই, একটা ভিডিওতে আমার দোকানটা রিভিউ দে তো!”
— “আমার ভাইকে শেখাস না কিভাবে এডিট করে?”
মতিউর হাসে। সে জানে, পরিশ্রম আর ধৈর্যই সবকিছু বদলে দিতে পারে।
একটা ফোন থেকে শুরু হয়েছিল তার ‘মোবাইল বিপ্লব’।
ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের শেষ দিকে মতিউরের ভিডিওগুলোতে একটু একটু করে ভিউ আসা শুরু করে। প্রথমে ২০০, তারপর ৫০০—একদিন একটা ভিডিও হঠাৎ ভাইরাল হয়ে যায়।
বিষয়টা ছিল: "গরিবের ছেলেও পারে – যদি মন থাকে"
ভিডিওতে সে নিজের গল্পই বলে। কীভাবে রাত জেগে SSC পড়েছে, কীভাবে মোবাইল ছাড়া জীবন চলেছে, আর কীভাবে এখন সে কন্টেন্ট বানিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।
ভিডিওটা ১ লাখ ভিউ পায় এক সপ্তাহে।
লাইক, কমেন্ট, শেয়ারে ঝড় ওঠে।
কিন্তু এটাই আবার তার জীবনে ঝামেলাও ডেকে আনে।
🎭 তার এলাকার কিছু বড় ভাই দেখা হলে বলত,
— "তুই দেখি এখন বড়লোক হইছোস!"
আর কিছু আত্মীয় বলত,
— "এইসব ফালতু ভিডিও বানিয়ে জীবনটা নষ্ট করতেছো। পড়ালেখা করো!"
বন্ধুরা তো আগেই নেগেটিভ ছিল। এখন আবার বলছে,
— "ভাই, আসলেই viral হইছো? কেমনে করসো রে!"
👉 মতিউরের জীবনে তখন দুই রকম মানুষ—
১. যারা তাকে টেনে নামাতে চায়,
২. আর যারা নিঃশব্দে অনুপ্রাণিত হয়।
তবে সে ভেঙে পড়ে না। সে জানে, এই ভিডিও বানানো শুধু তার শখ নয় — এটা তার জীবন গড়ার রাস্তা।
📚 সে এখন পড়াশোনাতেও সিরিয়াস। প্রতিদিন ২ ঘণ্টা ভিডিও বানায়, কিন্তু ৫ ঘণ্টা পড়াশোনায় সময় দেয়। মা তাকে দোয়া করে বলেন,
— “তুই ঠিক থাকলেই আমরা ঠিক আছি বাবা।”
📲 এবার সে নতুন একটা চিন্তা করে—
নিজের অ্যাপ বানাবে, যেখানে নতুন ছাত্রদের জন্য ফ্রি পড়ার ভিডিও থাকবে।
কারণ সে জানে, গ্রামের ছেলেরা কতটা পিছিয়ে আছে সুযোগ-সুবিধার অভাবে।
২০২৫ সালের মার্চ মাস।
মতিউর তখন ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। ক্লাসের চাপ, কলেজ লাইফ, আর ভিডিও বানানো—সব মিলিয়ে অনেক ব্যস্ততা।
📱 কিন্তু একদিন তার ফোনটা হঠাৎ নষ্ট হয়ে যায়।
তিন দিন ভিডিও দিতে না পারায় তার পেজের রিচ কমে যায়, সে ভেঙে পড়ে। অনেকেই বলে,
— “দেখছস তো, বেশি ভাব নিলে এই হয়!”
— “তোকে কে বলছে ভিডিও বানাতে?”
মতিউর মন খারাপ করে, রাতে চুপচাপ বসে থাকে। তখনই তার মা এসে পাশে বসে বলেন,
— “সেই মোবাইল তো আমি তোকে দেই নাই ভিডিও বানানোর জন্য, আমি তোকে দিছি ভালো কিছু করার জন্য। এবার যদি তুই হাল ছাড়িস, তাহলে মোবাইল তো না, তোর মনটাই ভেঙে যাবে।”
এই কথাগুলো মতিউরের মনে আগুন লাগিয়ে দেয়।
🔥 পরদিন সে পুরনো ফোনে কম মানের ভিডিও তুলে ফেসবুকে দেয় —
“মোবাইল নষ্ট হয়ে গেলেও স্বপ্ন এখনো বেঁচে আছে”
এই ভিডিওতে এমন ইমোশন ছিল যে, সেটাই আবার ভাইরাল হয়।
📞 এবার আসে প্রথম ব্র্যান্ড কল —
একটা স্থানীয় মোবাইল অ্যাকসেসরিজ শপ বলে,
— “ভাই, আমাদের দোকানের একটা ভিডিও দিলে, তোমাকে ফ্রি একটা ট্রাইপড আর লাইটিং দেব।”
এটাই ছিল মতিউরের প্রথম স্পন্সরশিপ!
🎤 এরপর তার স্কুল থেকে ফোন আসে—
“তুমি তো এখন অনেকের অনুপ্রেরণা। আমাদের স্কুলে এসে একদিন বক্তৃতা দেবে? ছোট ভাইদের বলবে কীভাবে তুমি এতদূর এসেছো?”
মতিউরের চোখে পানি চলে আসে। যেই স্কুলে সে একসময় হাসির পাত্র ছিল, সেখানেই আজ তাকে সম্মানের আসনে বসানো হচ্ছে।
Comments
Post a Comment